বগুড়া শব্দটা আলোচনায় এলেই চলে আরেকটা শব্দ দই। বগুড়ার দই। উত্তরবঙ্গের ‘গেটওয়ে’ বলে পরিচিত বগুড়া জেলা। কিন্তু দই কথাটা যেন এই জেলার নামের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার দইয়ের সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বগুড়ায় বাহিরের কেউ বেড়াতে এলে তার যেন দইটা চাখা চাই-ই চাই। এই জেলা থেকে বাহিরে বেড়াতে গেলেও তার সঙ্গী হয় দই। তাছাড়া বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও দই ছাড়া কল্পনা করা যায় না। অতিথি আপ্যায়নে দই যোগ করাটা এ এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নিতে যে কেউ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। খাওয়ার পর স্বীকার করেন, অন্য এলাকার দইয়ের সাথে এখানকার দইয়ের স্বাদ অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা অবশ্য প্রশংসার দিকেই ঝুঁকে থাকে। মোট কথা, বগুড়া আর দই শব্দগুলো সময়ের হাত ধরে একে অন্যের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বগুড়ার দই আর দইয়ের বগুড়া- এই কথাগুলো যেন সমান্তরাল।

বগুড়ার বিখ্যাত দই কিভাবে তৈরি করা হয়?
বগুড়া শব্দটা আলোচনায় এলেই চলে আরেকটা শব্দ। দই। বগুড়ার দই। উত্তরবঙ্গের ‘গেটওয়ে’ বলে পরিচিত বগুড়া জেলা। কিন্তু দই কথাটা যেন এই জেলার নামের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার দইয়ের সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বগুড়ায় বাহিরের কেউ বেড়াতে এলে তার যেন দইটা চাখা চাই-ই চাই। এই জেলা থেকে বাহিরে বেড়াতে গেলেও তার সঙ্গী হয় দই। তাছাড়া বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও দই ছাড়া কল্পনা করা যায় না। অতিথি আপ্যায়নে দই যোগ করাটা এ এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নিতে যে কেউ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। খাওয়ার পর স্বীকার করেন, অন্য এলাকার দইয়ের সাথে এখানকার দইয়ের স্বাদ অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা অবশ্য প্রশংসার দিকেই ঝুঁকে থাকে। মোট কথা, বগুড়া আর দই শব্দগুলো সময়ের হাত ধরে একে অন্যের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বগুড়ার দই আর দইয়ের বগুড়া- এই কথাগুলো যেন সমান্তরাল।

ইতিহাসঃ

ঐতিহ্যবাহী এই খাবার ব্যাপক প্রচলনের কারণে এটি সামাজিকতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে উৎপাদন ও বিপনন, চাহিদা ও জনপ্রিয়তা। দই তৈরির প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনও হয়েছে ব্যাপকভাবে। বানানগত দিক থেকেও ঘটেছে পরিবর্তন। আগে খাবারটি নাম লেখা হতো “দৈ”, অনুমান করা যায়, এখন থেকে প্রায় ২শ বছর আগে।

দেশভাগের কাছাকাছি সময়ে ভারত থেকে বগুড়ায় আসেন গৌরগোপাল ঘোষ। ঠাঁই নেন শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে শেরপুরে। আগে থেকেই তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে থাকত। নতুন জায়গায় এসে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করতে থাকেন। দই বানানোর কৌশল তাঁর আগে থেকেই জানা ছিল। তিনি দইয়ের স্বাদ ও মানে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। শেরপুরে দই বানিয়ে ভাঁড়ে করে হেঁটে হেঁটে শহরে চলে আসতেন ফেরি করে দই বিক্রির জন্য। দইয়ের সঙ্গে আনতেন সরভাজা। গৌরগোপালের সরভাজাই কিন্তু পরে সরার দই, মানে বগুড়ার দই হিসেবে সুখ্যাতি পায়।এখন আমরা বগুড়ার দই বলতে যা বুঝি, তা মূলত ওই গৌরগোপালেরই ফর্মুলা।

যাই হোক দিনে দিনে তাঁর সরভাজা এতই জনপ্রিয় হয় যে জমিদারবাড়িতেও সরবরাহের আদেশ পান। তার তৈরি করা দইয়ের (সরভাজা) স্বাদ পেয়ে উচ্ছ্বসীত হয়ে ওঠেন তৎকালীন পাকিস্তানের নওয়াব মোহাম্মদ আলী।বগুড়ার নওয়াব মোহাম্মদ আলীর পরিবার তাঁকে ডেকে প্যালেসের আমবাগানে গৌর গোপালকে বসত এবং দইয়ের কারখানা স্থাপনের জায়গা করে দেন। ষাটের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত সেই আমবাগানে গৌরগোপাল স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

প্রথমদিকে তিনি শুধু বগুড়ার দুটি নবাব পরিবারের জন্যই দই তৈরি করতেন। পরে তার ভাই সুরেন ঘোষের সাথে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে বগুড়ার দইয়ের এক নতুন যুগের সূচনা করেন। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলেন ঘোষ পরিবারের আরেক সদস্য কুরানু ঘোষ। এরপর দই শিল্পে সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়া করান মহরম আলী। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আকবরিয়া হোটেলও দই ব্যবসায় এগিয়ে আসে। ১৯৮৫ সালে আহসানুল কবির তার ‘দই ঘর’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দই শিল্পে নিয়ে আসেন আধুনিকায়ন। দই তৈরির প্রক্রিয়া, প্যাকিং এবং বিপননে তার প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি দইশিল্পের নতুন সম্ভাবনা খুলে দেয়। স্বাদের উন্নতি এবং পরিবহনের সুবিধাজনক পদ্ধতির কারণে বগুড়ার দই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সম্প্রতি দইয়ের স্বাদে নতুনত্ব আনায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে এশিয়া সুইটমিট। এছাড়াও শ্যামলি, রুচিতা, চিনিপাতা, সাউদিয়া, দইবাজার, ফুডভিলেজ নামের আরো শতাধিক প্রতিষ্ঠান দই উৎপাদন এবং বিপনন করছে বগুড়ায়।

তৎকালীন বাংলার বিট্রিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ায় আসেন। তিনি বগুড়ার নওয়াব বাড়ির আতিথ্য নিয়ে প্রথমবারের মতো বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নেন। তার জন্যে কাঁচের পাত্রে তৈরি করা বিশেষ ধরনের দই সরবরাহ করা হয়। দইয়ের স্বাদ তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে, তিনি এখানকার দই ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানও মেতে যান বগুড়ার দইয়ের সুস্বাদে। শোনা যায়, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পেতে তিনি সেখানকার কর্মকর্তাদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে বগুড়ার দই পাঠিয়েছেলেন।

দইয়ের একালঃ

সম্প্রতি জলপাইগুড়ি জেলার একটি সভায় বগুড়ার দই নিয়ে খুব কথাবার্তা হয়। সেখানকার বাণিজ্য মেলায় বগুড়ার দইয়ের চাহিদা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে ১০ মেট্রিক টন (৬০০ গ্রাম ওজনের ১৭ হাজারেরও বেশি সরা) দই সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যে এত পরিমাণ দই পাঠানো সম্ভব হয়নি। তবে ৫০০ কেজি দই পাঠানো হয়েছিল। সেখানকার লোক লাইন ধরে কিনেছিল। নিমাই ঘোষ, লিটন ঘোষ প্রমুখ দই উৎপাদনকারী জানালেন, পাতলা দই তৈরির ক্ষেত্রে আগের পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হয়। শুধু চিনির পরিবর্তে একই পরিমাণ দুধের মধ্যে দুই তোলা পরিমাণ স্যাকারিন ব্যবহার করতে হয়। শেরপুরের মতো সুস্বাদু ও মানসম্পন্ন দই দেশের আর কোথাও তৈরি হয় না। কারণ এখানকার আবহাওয়া দই তৈরির জন্য ভালো। এখানকার পানিও সুস্বাদু। তা ছাড়া এত দক্ষ কারিগরও অন্য কোথাও মিলবে না। এখন শেরপুরের বিখ্যাত দইয়ের দোকান সাউদিয়া, জলযোগ, বৈকালী, আলিবাবা, সম্পা ইত্যাদি। দই কয়েক রকম হয়ে থাকে—টক দই, সাদা দই, চিনিপাতা দই ও মিষ্টি দই। সাধারণত মাটির পাত্রে দই বাজারজাত করা হয়। সরা, পাতিল, বারকি, কাপ, বাটি ইত্যাদি নাম এসব পাত্রের।

বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় স্থানীয় কায়দায় বানানো দই বগুড়ার দই নামে বিক্রি করা হয়। কোথাও কোথাও অবশ্য সত্যি সত্যি বগুড়া থেকে নিয়ে গিয়ে দই বিক্রি করা হয়। রঙ এর দিক থেকে বগুড়ার দই হালকা লালচে হয়।

উপকরণঃ

এক কেজি দই বানানোর জন্য নিতে হবে গরুর দুধ ২ কেজি, চিনি ২৫০ গ্রাম, সামান্য পরিমাণ পুরোনো দই এবং মাটির একটি হাঁড়ি ও সরা।

প্রণালীঃ
একটি পরিষ্কার কড়াই বা পাতিলে দুধ ছেঁকে ঢেলে দিন। কড়াই চুলাতে বসান। এবার জ্বাল দিতে থাকুন। চুলায় আগুন যত ধীরে জ্বলবে দই তত সুস্বাদু হবে। আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী, সাদা বা ঘিয়ে রঙের দই তৈরি করবেন। সাদা রঙের দই তৈরি করতে চাইলে ঘণ্টা দুয়েক পর কড়াই নামিয়ে ফেলুন। আর ঘিয়ে রঙের দইয়ের জন্য তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা চুলাতে কড়াই রাখুন। দুধ ফুটিয়ে দুই কেজি থেকে এক কেজিতে এলে তাতে চিনি ঢেলে দিন। চিনি না গলা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। দুধ উথলে উঠলে কড়াই নামিয়ে ফেলুন। ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। মাটির হাঁড়ি বা সরা একটু গরম করুন। এবার সরায় ঠান্ডা দুধ ঢেলে নিন। পুরোনো এক চিমটি দই দুধের সঙ্গে ভালোভাবে মেশান। এবার ঝাঁপি দিয়ে সরা ঢেকে দিন। ছাইচাপা আগুনে সরা বসিয়ে চার ঘণ্টা রেখে দিন। জমাট না বাঁধলে আরও দেড়-দুই ঘণ্টা সময় নিন। জমাট বাঁধার পর ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন।

স্বাদঃ

স্বাদে অসাধারণ, মিষ্টি, নরম, মুখে দিলে যেন গলে যায়। বগুড়া ছাড়া ও অনেক জায়গায় এখন দই পাওয়া যায়।  খুলনা, সাতক্ষীরা, সিলেট, ঢাকাসহ অনেক জায়গায় দই পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলোর স্বাদ বগুড়ার দই এর স্বাদের ধারে কাছেও না।

(Visited 2 times, 1 visits today)

Thank you for reading!

বগুড়া শব্দটা আলোচনায় এলেই চলে আরেকটা শব্দ দই। বগুড়ার দই। উত্তরবঙ্গের ‘গেটওয়ে’ বলে পরিচিত বগুড়া জেলা। কিন্তু দই কথাটা যেন এই জেলার নামের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার দইয়ের সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বগুড়ায় বাহিরের কেউ বেড়াতে এলে তার যেন দইটা চাখা চাই-ই চাই। এই জেলা থেকে বাহিরে বেড়াতে গেলেও তার সঙ্গী হয় দই। তাছাড়া বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও দই ছাড়া কল্পনা করা যায় না। অতিথি আপ্যায়নে দই যোগ করাটা এ এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নিতে যে কেউ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। খাওয়ার পর স্বীকার করেন, অন্য এলাকার দইয়ের সাথে এখানকার দইয়ের স্বাদ অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা অবশ্য প্রশংসার দিকেই ঝুঁকে থাকে। মোট কথা, বগুড়া আর দই শব্দগুলো সময়ের হাত ধরে একে অন্যের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বগুড়ার দই আর দইয়ের বগুড়া- এই কথাগুলো যেন সমান্তরাল।

বগুড়ার বিখ্যাত দই কিভাবে তৈরি করা হয়?
বগুড়া শব্দটা আলোচনায় এলেই চলে আরেকটা শব্দ। দই। বগুড়ার দই। উত্তরবঙ্গের ‘গেটওয়ে’ বলে পরিচিত বগুড়া জেলা। কিন্তু দই কথাটা যেন এই জেলার নামের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার দইয়ের সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বগুড়ায় বাহিরের কেউ বেড়াতে এলে তার যেন দইটা চাখা চাই-ই চাই। এই জেলা থেকে বাহিরে বেড়াতে গেলেও তার সঙ্গী হয় দই। তাছাড়া বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও দই ছাড়া কল্পনা করা যায় না। অতিথি আপ্যায়নে দই যোগ করাটা এ এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নিতে যে কেউ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। খাওয়ার পর স্বীকার করেন, অন্য এলাকার দইয়ের সাথে এখানকার দইয়ের স্বাদ অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা অবশ্য প্রশংসার দিকেই ঝুঁকে থাকে। মোট কথা, বগুড়া আর দই শব্দগুলো সময়ের হাত ধরে একে অন্যের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বগুড়ার দই আর দইয়ের বগুড়া- এই কথাগুলো যেন সমান্তরাল।

ইতিহাসঃ

ঐতিহ্যবাহী এই খাবার ব্যাপক প্রচলনের কারণে এটি সামাজিকতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে উৎপাদন ও বিপনন, চাহিদা ও জনপ্রিয়তা। দই তৈরির প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনও হয়েছে ব্যাপকভাবে। বানানগত দিক থেকেও ঘটেছে পরিবর্তন। আগে খাবারটি নাম লেখা হতো “দৈ”, অনুমান করা যায়, এখন থেকে প্রায় ২শ বছর আগে।

দেশভাগের কাছাকাছি সময়ে ভারত থেকে বগুড়ায় আসেন গৌরগোপাল ঘোষ। ঠাঁই নেন শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে শেরপুরে। আগে থেকেই তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে থাকত। নতুন জায়গায় এসে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করতে থাকেন। দই বানানোর কৌশল তাঁর আগে থেকেই জানা ছিল। তিনি দইয়ের স্বাদ ও মানে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। শেরপুরে দই বানিয়ে ভাঁড়ে করে হেঁটে হেঁটে শহরে চলে আসতেন ফেরি করে দই বিক্রির জন্য। দইয়ের সঙ্গে আনতেন সরভাজা। গৌরগোপালের সরভাজাই কিন্তু পরে সরার দই, মানে বগুড়ার দই হিসেবে সুখ্যাতি পায়।এখন আমরা বগুড়ার দই বলতে যা বুঝি, তা মূলত ওই গৌরগোপালেরই ফর্মুলা।

যাই হোক দিনে দিনে তাঁর সরভাজা এতই জনপ্রিয় হয় যে জমিদারবাড়িতেও সরবরাহের আদেশ পান। তার তৈরি করা দইয়ের (সরভাজা) স্বাদ পেয়ে উচ্ছ্বসীত হয়ে ওঠেন তৎকালীন পাকিস্তানের নওয়াব মোহাম্মদ আলী।বগুড়ার নওয়াব মোহাম্মদ আলীর পরিবার তাঁকে ডেকে প্যালেসের আমবাগানে গৌর গোপালকে বসত এবং দইয়ের কারখানা স্থাপনের জায়গা করে দেন। ষাটের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত সেই আমবাগানে গৌরগোপাল স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

প্রথমদিকে তিনি শুধু বগুড়ার দুটি নবাব পরিবারের জন্যই দই তৈরি করতেন। পরে তার ভাই সুরেন ঘোষের সাথে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে বগুড়ার দইয়ের এক নতুন যুগের সূচনা করেন। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলেন ঘোষ পরিবারের আরেক সদস্য কুরানু ঘোষ। এরপর দই শিল্পে সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়া করান মহরম আলী। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আকবরিয়া হোটেলও দই ব্যবসায় এগিয়ে আসে। ১৯৮৫ সালে আহসানুল কবির তার ‘দই ঘর’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দই শিল্পে নিয়ে আসেন আধুনিকায়ন। দই তৈরির প্রক্রিয়া, প্যাকিং এবং বিপননে তার প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি দইশিল্পের নতুন সম্ভাবনা খুলে দেয়। স্বাদের উন্নতি এবং পরিবহনের সুবিধাজনক পদ্ধতির কারণে বগুড়ার দই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সম্প্রতি দইয়ের স্বাদে নতুনত্ব আনায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে এশিয়া সুইটমিট। এছাড়াও শ্যামলি, রুচিতা, চিনিপাতা, সাউদিয়া, দইবাজার, ফুডভিলেজ নামের আরো শতাধিক প্রতিষ্ঠান দই উৎপাদন এবং বিপনন করছে বগুড়ায়।

তৎকালীন বাংলার বিট্রিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ায় আসেন। তিনি বগুড়ার নওয়াব বাড়ির আতিথ্য নিয়ে প্রথমবারের মতো বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নেন। তার জন্যে কাঁচের পাত্রে তৈরি করা বিশেষ ধরনের দই সরবরাহ করা হয়। দইয়ের স্বাদ তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে, তিনি এখানকার দই ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানও মেতে যান বগুড়ার দইয়ের সুস্বাদে। শোনা যায়, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পেতে তিনি সেখানকার কর্মকর্তাদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে বগুড়ার দই পাঠিয়েছেলেন।

দইয়ের একালঃ

সম্প্রতি জলপাইগুড়ি জেলার একটি সভায় বগুড়ার দই নিয়ে খুব কথাবার্তা হয়। সেখানকার বাণিজ্য মেলায় বগুড়ার দইয়ের চাহিদা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে ১০ মেট্রিক টন (৬০০ গ্রাম ওজনের ১৭ হাজারেরও বেশি সরা) দই সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যে এত পরিমাণ দই পাঠানো সম্ভব হয়নি। তবে ৫০০ কেজি দই পাঠানো হয়েছিল। সেখানকার লোক লাইন ধরে কিনেছিল। নিমাই ঘোষ, লিটন ঘোষ প্রমুখ দই উৎপাদনকারী জানালেন, পাতলা দই তৈরির ক্ষেত্রে আগের পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হয়। শুধু চিনির পরিবর্তে একই পরিমাণ দুধের মধ্যে দুই তোলা পরিমাণ স্যাকারিন ব্যবহার করতে হয়। শেরপুরের মতো সুস্বাদু ও মানসম্পন্ন দই দেশের আর কোথাও তৈরি হয় না। কারণ এখানকার আবহাওয়া দই তৈরির জন্য ভালো। এখানকার পানিও সুস্বাদু। তা ছাড়া এত দক্ষ কারিগরও অন্য কোথাও মিলবে না। এখন শেরপুরের বিখ্যাত দইয়ের দোকান সাউদিয়া, জলযোগ, বৈকালী, আলিবাবা, সম্পা ইত্যাদি। দই কয়েক রকম হয়ে থাকে—টক দই, সাদা দই, চিনিপাতা দই ও মিষ্টি দই। সাধারণত মাটির পাত্রে দই বাজারজাত করা হয়। সরা, পাতিল, বারকি, কাপ, বাটি ইত্যাদি নাম এসব পাত্রের।

বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় স্থানীয় কায়দায় বানানো দই বগুড়ার দই নামে বিক্রি করা হয়। কোথাও কোথাও অবশ্য সত্যি সত্যি বগুড়া থেকে নিয়ে গিয়ে দই বিক্রি করা হয়। রঙ এর দিক থেকে বগুড়ার দই হালকা লালচে হয়।

উপকরণঃ

এক কেজি দই বানানোর জন্য নিতে হবে গরুর দুধ ২ কেজি, চিনি ২৫০ গ্রাম, সামান্য পরিমাণ পুরোনো দই এবং মাটির একটি হাঁড়ি ও সরা।

প্রণালীঃ
একটি পরিষ্কার কড়াই বা পাতিলে দুধ ছেঁকে ঢেলে দিন। কড়াই চুলাতে বসান। এবার জ্বাল দিতে থাকুন। চুলায় আগুন যত ধীরে জ্বলবে দই তত সুস্বাদু হবে। আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী, সাদা বা ঘিয়ে রঙের দই তৈরি করবেন। সাদা রঙের দই তৈরি করতে চাইলে ঘণ্টা দুয়েক পর কড়াই নামিয়ে ফেলুন। আর ঘিয়ে রঙের দইয়ের জন্য তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা চুলাতে কড়াই রাখুন। দুধ ফুটিয়ে দুই কেজি থেকে এক কেজিতে এলে তাতে চিনি ঢেলে দিন। চিনি না গলা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। দুধ উথলে উঠলে কড়াই নামিয়ে ফেলুন। ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। মাটির হাঁড়ি বা সরা একটু গরম করুন। এবার সরায় ঠান্ডা দুধ ঢেলে নিন। পুরোনো এক চিমটি দই দুধের সঙ্গে ভালোভাবে মেশান। এবার ঝাঁপি দিয়ে সরা ঢেকে দিন। ছাইচাপা আগুনে সরা বসিয়ে চার ঘণ্টা রেখে দিন। জমাট না বাঁধলে আরও দেড়-দুই ঘণ্টা সময় নিন। জমাট বাঁধার পর ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন।

স্বাদঃ

স্বাদে অসাধারণ, মিষ্টি, নরম, মুখে দিলে যেন গলে যায়। বগুড়া ছাড়া ও অনেক জায়গায় এখন দই পাওয়া যায়।  খুলনা, সাতক্ষীরা, সিলেট, ঢাকাসহ অনেক জায়গায় দই পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলোর স্বাদ বগুড়ার দই এর স্বাদের ধারে কাছেও না।

(Visited 2 times, 1 visits today)

Thank you for reading!