ইতালীয় আবেগের নাম পাস্তা
ইতালীয়দের একটি আবেগের নাম পাস্তা। ইতালীয়দের কাছে এটা শুধু খাবার নয়। পাস্তার সাথে তাদের অনেক আবেগ ভালোবাসা জড়িত।
বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ইতালীয় খাবারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন পাস্তা। ইতালীয়দের কাছে পাস্তা নিছক খাবারই নয়, এক বিশুদ্ধ আবেগের নাম। ইতালীয় খাবার অগ্রাহ্য করে যেমন ইতালির ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না, তেমনি পাস্তার আখ্যান অগ্রাহ্য করে ইতালীয় খাবারের ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না। পাস্তার আকৃতির মতোই প্যাঁচানো এর সুদীর্ঘ ইতিহাস। আজ আমরা ইতিহাসের এই প্যাঁচানো গলিতেই ঘুরে আসব।
ইতালি তে পাস্তার উদ্ভাবন ও প্রচলন নিয়ে রয়েছে নানা জনের নানা মত। ১৩ শতাব্দীর বিখ্যাত ভেনিসিয় পর্যটক ও বণিক মার্কো পোলো-র এক লেখা অনুযায়ী অনেকে বিশ্বাস করতেন তিনি চীন থেকে ইতালিতে পাস্তা নিয়ে এসেছিলেন। তবে বিশেষজ্ঞরা একে মিথ বলেই বিবেচনা করেন। আসলে পোলোর লেখায় একধরনের গাছের কথা উল্লেখ যা থেকে পাস্তার মতো খাবার বানানো হতো। লেখায় বর্ণনাকৃত গাছটি খুবসম্ভব সাগু পাম ছিলো। পোলোর সময়ের অনেক আগে থেকেই ইতালিতে পাস্তার প্রচলন ছিলো।
১২০৭ সালে উত্তর ইতালির জেনোয়া শহরে এক সৈনিকের কাছে ম্যাকারনির ঝুড়ির বর্ণনা পাওয়া যায় ইতিহাসে। এরও এক শতাব্দী আগে মুসলিম ভৌগলিক আল ইদ্রিসের লেখায় সিসিলিতে পাস্তা উৎপাদনের কথা জানা যায়। অনেক ইতালীয়র মতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এক সমাধিতে পাস্তা বানানোর সরঞ্জামের চিত্রায়ন দেখা যায়। যা থেকে ধারণা করা হয় প্রাক-রোমান ইতালিতেও পাস্তার প্রচলন ছিলো। তবে বেশীরভাগ খাদ্য ইতিহাসবিদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
বর্তমানে পাস্তায় ব্যবহৃত ডুরাম গমের আটা (এক ধরনের শক্ত আটা) থেকেই ইট্রোস্কো-রোমান যুগে লাগানে (বর্তমান নাম লাজানিয়া) বানানো হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একে পাস্তার আদিরূপ বলেই ধরা হয়। প্রথম শতাব্দীতে এ ধরনের ওভেন-বেকড খাবারের উদ্ভাবন হয়। সর্বব্যাপী প্রচলিত আধুনিক পাস্তার প্রচলন আরও কয়েক শতাব্দী পর শুরু হয়।
অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমন দক্ষিণ ইতালীয় সংস্কৃতির সকল উপাদানের মতো আঞ্চলিক রন্ধনপ্রণালীতেও প্রভাব পড়ে। মধ্যযুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত দক্ষিণ উপদ্বীপে আরবদের অবস্থানের প্রভাবে পাস্তার স্বাদের নানা পরিবর্তন ঘটেছে। পাস্তায় দারুচিনি ও কিসমিসের ব্যবহার আরবীয়দেরই প্রভাবে।
প্রাচীন পাস্তা তৈরীর প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। সারাদিনব্যাপী ডুরাম আটার খামির বানানো, নির্দিষ্ট আকৃতিতে কাটা, রোদে শুকানো ইত্যাদি কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে পাস্তা বানানো হতো। প্রথমে সিসিলিতে পাস্তার প্রচলন হলেও ইতালিব্যাপী ডুরাম আটা উৎপাদন সমৃদ্ধি লাভের ফলে পাস্তার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে।
চতুর্দশ শতাব্দীতে শুকনো পাস্তা এর পুষ্টিগুণ ও দীর্ঘ সংরক্ষণশীলতার কারণে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইতালীয়রা সমুদ্রযাত্রায় পাস্তা সাথে রাখতো। যাত্রাপথে অধিক প্রচলনের মাধ্যমে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে পাস্তা প্রীতি। ততদিনে পাস্তা বানানোর নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হওয়ায় অনেক সহজেই তা বানানো যেত। সহজ পদ্ধতির কারণে ইতালির প্রধান খাবারে পরিণত হয় পাস্তা।
পাস্তা ইতিহাসে নতুন যুগ শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে টমেটো ব্যবহারের সূচনার ফলে। টমেটো আবিষ্কারের প্রথম দিকে একে বিষাক্ত নাইটশেড ধরনের ফল ভাবা হতো। বিষাক্ত ফল মনে করায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত একে খাওয়ার অনুপযুক্ত ধরা হতো। ১৮৩৯ সালে সর্বপ্রথম পাস্তা তৈরিতে টমেটো ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে পাস্তা টমেটোর যুগলবন্দীতে অসাধারণ স্বাদের প্রচলন ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী ।
ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত পাস্তা ছিল অভিজাত শ্রেণীর খাবার। ধনী সমাজের ভোজের আয়োজনে পাস্তা অনন্য স্থান দখল করে ছিলো। বিভিন্ন ধরনের চিজ, মাংস প্রভৃতি উপকরণ যোগ করে পাস্তাকে এক লোভনীয় খাবার রূপে উপস্থাপন করা হতো। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে নেপলস ও সিসিলিতে ধনী-গরীব সকল শ্রেণীর খাবার হিসেবে সমাদৃত হয় পাস্তা।
পাস্তার অসংখ্য রকমফেরের মধ্যে দুই ধরণের পাস্তা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ড্রাই বা শুষ্ক পাস্তা ও ফ্রেশ বা টাটকা পাস্তা।
ইতালিতে আকারভেদে প্রায় ৩০০ ধরনের ড্রাই পাস্তা পাওয়া যায়। বো-টাই বা প্রজাপতি আকৃতি থেকে শুরু করে টেনিস র্যাকেটের আকৃতির মতো বিচিত্র আকারের পাস্তা পাওয়া যায়। বিভিন্ন এসব আকৃতির মূল উদ্দেশ্য হলো পাস্তায় সস আটকানোর ব্যবস্থা করা। আকৃতি অনুযায়ী নানা পাস্তায় নানা ধরনের সস ব্যবহৃত হয়। ড্রাই পাস্তা বানানোর মূল পদ্ধতি হলো ডুরাম আটার সাথে পানি ও প্রয়োজনমত অম্ল ব্যবহার করে খামির বানানো। এরপর তামার তৈরি ছাঁচে কেটে পাস্তা শুকানো হয়। তামার ছাঁচ ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী স্টিলের ছাঁচে পাস্তা বানায়। কিন্তু এই পাস্তার গুণগতমান বিখ্যাত ইতালীয় পাস্তার মতো ভালো হয় না।
ফ্রেশ পাস্তা নরম ধরনের হয়ে থাকে। সব পাস্তাই প্রস্তুত প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে ফ্রেশ পাস্তা থাকে। একে সংরক্ষণ করা যায় না। বানানোর পরপরই তা সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। উত্তর ইতালিতে ময়দা ও ডিম দিয়ে ফ্রেশ পাস্তার খামির তৈরি হয় আবার দক্ষিণ ইতালিতে সুজি ও পানি দিয়ে খামির তৈরি করা হয়। পাস্তা তৈরির পর একে নানা ধরনের সস দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে খাদ্যপ্রেমীদের অন্যতম ভালোবাসা পাস্তা। আমেরিকায় প্রতিবছর গড়ে একজন মানুষ ২০ পাউন্ড পাস্তা খায়। অপরদিকে ইতালিতে প্রতিবছর ৬০ পাউন্ড পাস্তা খায় একজন মানুষ। পাস্তার এই তুমুল জনপ্রিয়তার ছাড়িয়ে গেছে ইতালিতে ডুরাম আটার উৎপাদনকে। তাই পাস্তা তৈরির জন্য বর্তমানে অন্যান্য দেশ থেকে আটা আমদানি করতে হয় ইতালিতে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও স্বাগত ও সমাদৃত হয়েছে পাস্তার স্বাদ। বর্তমানে রেস্টুরেন্টগুলোতে বাঙালির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই ইতালীয় আবেগ।
ঈন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত
Thank you for reading!